ছোটগল্প(সূচনা পর্ব ২)
ছোটগল্প (সূচনা পর্ব ২)
.......সূচনা পর্ব ১-এর পর।
ত্রিশ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ
ছোটগল্প রচনা শুরু করেন। ছোটগল্প রচনার সঙ্গে তাঁর জমিদারি তদারকির একটা গভীর
সম্পর্ক রয়েছে। এ উপলক্ষে কুষ্টিয়া,
শিলাইদহ, পাবনা, রাজশাহী, পতিসর, শাহজাদপুর প্রভৃতি অঞ্চল ঘুরতে গিয়ে
তিনি নিবিড়ভাবে পরিচিত হন পদ্মা, গড়াই, নাগর ও ইছামতী নদী এবং
গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে। ফলে তাঁর প্রথমদিকের লেখায় এসব বিষয় রয়েছে। ইমপ্রেসনিস্ট শিল্পীদের মতো জীবনের রং ও রূপ কাছ থেকে উপভোগ করে
তিনি তাঁর গল্পে স্থান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথই যথার্থ অর্থে বাংলা ছোটগল্পে জীবন
দান করেন।
বিষয়বস্ত্ত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের
গল্পে প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, সামাজিক জীবন, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক
ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। প্রেমের গল্প হিসেবে মহামায়া,মাল্যদান,শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, অধ্যাপক, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, পাত্র ও পাত্রী, মানভঞ্জন,ল্যাবরেটরি প্রভৃতি গল্পের নাম উল্লেখ করা যায়। প্রকৃতিবিষয়ক
গল্পের মধ্যে অতিথি, বলাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব গল্পে
প্রকৃতিপ্রেমিক নারী ও বালক চরিত্রগুলি হয়েছে যেন প্রকৃতির সন্তান।
সমাজজীবনের
সম্পর্কবৈচিত্র্য নিয়ে রচিত গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পণরক্ষা, পোস্টমাস্টার,কাবুলিওয়ালা,হৈমন্তী, কর্মফল, দান-প্রতিদান, দেনা-পাওনা, ছুটি,খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি।
অতিপ্রাকৃত রসের স্পর্শ লেগেছে গুপ্তধন, জীবিত ও মৃত,
মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, মাস্টারমশাই ইত্যাদি গল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম সার্থকভাবে
বাংলা ছোটগল্পকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।
রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ছোটগল্পকারদের
মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর (১৮৬৩-১৯৪৯) নাম। বাংলা
ব্যঙ্গগল্পের ধারায় তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর বিশিষ্ট গল্পগুলি হলো- আমরা কি ও কে,পাথেয়, দুঃখের দেওয়ালী।
এর পরের
ছোটগল্পকার হলেন প্রথম চৌধুরী
(১৮৬৮-১৯৪৬)। তিনি ছোটগল্প রচনায় অনেকটা দক্ষতা দেখালেও রূপসংহতির অভাবে তাঁর
কোনো গল্পই পূর্ণাঙ্গ ছোটগল্প হয়ে ওঠেনি। তাঁর গল্পগ্রন্থের মধ্যে চার-ইয়ারি কথা,
নীললোহিত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর(১৮৭৬-১৯৩৮)
আবির্ভাব বাংলা ছোটগল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘মন্দির’ তাঁকে এ ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য এনে
দেয়। এ ছাড়া কাশীনাথ, বৈরাগী, মামলার ফল,মুষ্টিমেয়, অভাগীর স্বর্গ, মহেশ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প।
এসব গল্পে বঞ্চিতদের বেদনার কাহিনী জীবনসন্ধানী শিল্পী হিসেবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভের ফলে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৩৮)
সূক্ষ্ম জীবনদৃষ্টি নিয়ে ছোটগল্প লিখেছেন। পুষ্পপাত্র, সওগাত, ধূপছায়া, মণিমঞ্জরী ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পসংকলন।
বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৯৪-১৯৫০) রচিত ছোটগল্পগুলি কল্পনাপ্রবণতা ও অনুভূতির গাঢ়তায়
চমৎকার। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে মেঘমল্লার, যাত্রীবদল, জন্ম ও মৃত্যু, কিন্নরদল, বিধু মাস্টার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৯৮-১৯৭১) বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে বেশিরভাগ গল্প রচনা করেছেন। পাষাণপুরী,
নীলকণ্ঠ, রসকলি, তিনশূন্য ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ তাঁর
সৃজনশীল প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর গল্পে
বেদে, পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার, ডাকহরকরা ইত্যাদি সাধারণ শ্রেণীর
মানুষের জীবনচিত্র দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে প্রধানত যৌবনের জয়গান
গেয়েছেন। তাঁর প্রথম গল্পসংকলন ব্যথার দান-এ (১৯২২) গদ্যকাব্যের আভাস যাওয়া
যায়। নজরুলের গল্পের একটি চমৎকার সংকলন হচ্ছে শিউলিমালা (১৯৩১)। এ গ্রন্থে তিনি
হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। রিক্তের বেদন (১৯২৫) তাঁর অপর একটি
বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। তাঁর অধিকাংশ গল্পেই নর-নারীর প্রেম প্রাধান্য পেয়েছে।
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৭৬)
খনি শ্রমিকদের নিয়ে গল্প রচনার পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত। তাঁর প্রতিভার নিদর্শনস্বরূপ
অতসী, বধূবরণ, মারণযন্ত্র,দিনমজুর ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়। বাংলা ছোটগল্পে
তিনিই প্রথম আঞ্চলিকতা প্রয়োগ করেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৫-১৯৫৬) কল্লোলগোষ্ঠীর বাস্তবধর্মিতার আদর্শ
নিয়ে ছোটগল্পে আবির্ভূত হন। তিনি সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক জীবনদৃষ্টির মাধ্যমে
গল্পে জীবনের আন্তর সত্যকে খুঁজেছেন। মানবজীবনের জৈবিক চাহিদা বলে খ্যাত
ফ্রয়েডীয় চেতনা তাঁর গল্পে বারবার উঁকি দিয়েছে। তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ (১৯৩৭) গল্পটি নৃশংসতা ও
প্রতিহিংসাপরায়ণতার জোরালো অভিব্যক্তি। তাঁর ‘সরীসৃপ’ (১৯৩৯) গল্পটি একজন পুরুষের মনোলোকের
সরীসৃপ-লীলাকে অবলম্বন করে রচিত। এ ছাড়া তাঁর গল্পগ্রন্থসমূহের মধ্যে অতসীমামী ও অন্যান গল্প (১৯৩৫), মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮),বৌ (১৯৪৩),ভেজাল (১৯৪৪),
আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মাটির মাশুল
(১৯৪৮), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩), শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৫০) ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য।
প্রবোধকুমার সান্যালের (১৯০৫-১৯৮৩)
গল্প লেখার রীতি সহজ-সরল ও হূদয়গ্রাহী। চেনা ও জানা, নিশিপদ্ম, অবিকল, অঙ্গরাগ, কয়েক ঘণ্টা মাত্র, দিবাচল, গল্পসঞ্চয়ন, নওরঙ্গী, মধুকরী, মাস, নীচের তলায়, অঙ্গার, কাদামাটির দুর্গ, সায়াহ্ন, পঞ্চতীর ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।
বিভাগপূর্বকালে ছোটগল্প রচনায় খ্যাতি
লাভ করেছিলেন এমন আরো কয়েকজন লেখক হলেন:
দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার,
রাজশেখর বসু, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়,
সতীনাথ ভাদুড়ী, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ।
এইভাবে ছোটগল্প আমাদের দিয়ে যাক অনেক অনেক খুশি ও আনন্দ।
একটি বংWall Official-এর উপস্থাপনা।
No comments