ভাগ্যের পরিহাস (পর্ব ১)
ভাগ্যের পরিহাস (পর্ব১)
চাকরিসূত্রে বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে থাকি।দূরত্ব ৩০ কি.মি.।ওখানেই থাকি স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে।বিগত বিশ দিন বাদে পাড়ায় পা রাখলাম।প্রথমেই দেখা হয়ে গেলো প্রদীপ-এর সঙ্গে।দাঁড় করিয়ে বলল এখুনি এলে নাকি অরুনদা? হ্যাঁ। বলার সঙ্গে সঙ্গে বললো- বৌদি আসেনি?
বললাম- না। ও তার ভাইয়ের কাছে আসানসোলে গেছে।
ও আমার কাছে সরে এসে চারিদিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বললো পাড়ায় হুলুস্থুলু কান্ড।চারিদিকে ঢি-ঢি পরে গেছে। তুমি শোনোনি?
অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলাম কি শুনবো? কি কান্ড?কে করেছে?
-কে আবার!ওই তোমার পরম বন্ধু অবনী মাস্টার।
হতবাক আমি।কান্ড করবে অবনী মাস্টার!নিরীহ গোবেচারা চিরকুমার।যে কিনা আর পাঁচ বছর পার আমার সঙ্গে স্কুল মাস্টারের পদ থেকে অবসর নেবে।নির্ঘাত কেউ ফাঁদে ফেলেছে। তবুও সন্দেহের অবাসন করতে জানতে চাইলাম- কিটা করেছে সেটা বলবে তো?
- কি আবার করবে।বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে।
অধৈর্য্য হয়ে বললাম- আঃ প্রদীপ! খোলসা করে বোলো অবনী কি করেছে?
বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে নিয়ে প্রদীপ বললো- বিয়ে করেছে গো বিয়ে।
ধমকে উঠলাম আমি।ফচকামী করার জায়গা পাওনা? সরে দাঁড়াও আমাকে যেতে দাও।
মাথা চুলকে প্রদীপ বললো- ফচকামী করবো কেন অরুণদা? তুমি কি আমায় বখশিস দিবে? না আমি বিনে পয়সায় ভাত-কাপড় পাবো? এইতো গত পাঁচ দিন আগের কথা। এতবড়ো একটা ধিঙ্গি বউ নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলো অবানিদা। আগে থেকে জানতে পেরে চোখের সামনেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে অখিল। অনেক ডাকা-ডাকির পরও দরজা খুলেনি কেউ। বেচারা অবনীদা সদ্য বিয়ে করা বৌ নিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলো কে জানে।
প্রদীপ অখিলের বখাটে বন্ধু।বিশ্বাস করতে পারলাম না ওর কথা।তাছাড়া অবনীর নামে মিথ্যে অপবাদ সহ্য করতে পারলাম না আমি।রগে টগবগ করে উঠলো গায়ের রক্ত।
গলায় জোর দিয়ে বললাম-অখিলের কি হোক আছে দরজা বন্ধ করার? বাড়িটাতো অবনীই বানিয়েছে?
বুক ফুলিয়ে প্রদীপ বললো- অখিলের হক আছে ও তার ভাই বলে।দাদা অনাচার করবে আর ভাই সেটা মেনে নেবে? বানিয়েছে বলেই সেই বাড়িতে সে যা খুশি তাই করবে? দেখো অরুণদা- বন্ধু বলে তোমার দরদ উথলে উঠতে পারে,কিন্তু পাড়ার আমরা সবাই তাই সহ্য করবো কেন?
ধমকে উঠে বললাম- ঠিক করে কথা বল প্রদীপ। বিয়ে করাটা যদি অনাচার হয় তাহলে তুমি আমি এবং বিবাহিত সকলেই তো সেই দোষে দোষী।তবে আমাদেরই বা ঘরে থাকার হক থাকবে কেন?
চোখ কপালে তুলে প্রদীপ বললো- আমাদের বিয়ে আর অবনীদার বিয়ে এক হলো?
- এক নয় কেন? তফাতটা কোথায় সেটা বুঝিয়ে বোলো।
থ মেরে গেলো প্রদীপ।তোতলাতে তোতলাতে বললো- না, মানে আমরা যখন বিয়ে করেছিলাম তখন, তখন আমাদের বয়সটা ছিল একুশ থেকে পঁচিশের মধ্যে।আর অবানিদার বয়সটা-
ওর মুখ থেকে কথাটা টেনে নিয়ে বললাম- পঞ্চান্ন হয়েছে বলে তার বিয়ে করাটা অনাচার? তাই যদি হয় গত চারমাস আগে সোমা কাকিমা মারা যাবার পর সাতান্ন বছরে শশধর কাকা যখন বিয়ে করলো,কোই তখন তো তার ঘরের দরজা কেউ বন্ধ করে দেয়নি?
মুখে খই ফুটিয়ে প্রদীপ বললো- কেন দেবে শুনি? শশধর কাকা বিযে না করলে ওর বাচ্চা-কাচ্চা-সংসার কে দেখতো?অতলে ডুবে যেত ওর ভরা সংসার।
- ওঃ! তাই শশধর কাকার কোনো দোষ নেই।কিন্তু অবনীর ছেলেমেয়ে সংসার না থাকলেও অতো নিজেই একজন জলজ্যান্ত মানুষ।ওর রোগব্যাধি আছে।ত্খন ওকে কে দেখবে?
- তাহলে এতদিন ওকে কে দেখেছিলো শুনি?
- দেখেছিলো ভাইবোনেরা।তাই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাপ-মা মোর ভাইবোনেদের জন্য।
- এখনও ওরাই দেখবে।
- না, এখন ওরা দেখতে পারবেনা।বোনেরা শশুরবাড়ি চলে গেছে।ভাই এখন বৌয়ের বর।সুতরাং,ওরা নাকি আর অবনীর দেখাশোনা কিংবা রান্নাবান্না করে দিতে পারবেনা।
- তাই নাকি! অখিল বলেছে ওই কথা?
- না! বলেছে ওর বৌ।আর সর্বান্তকরণে সেটা সমর্থন করছে অখিল।
- কি বলেছে অখিলের বৌ?
- সাকিব কথা কি বলা যায়?তার মধ্যে একটি হলো 'বিয়ে না করে যদি মদন বিজয়ী হওয়ার ইচ্ছা তাহলে সন্ন্যাসী হলেন না কেন?' সংসারে থাকার দরকারটাই বা কি? কে নেবে উনার দ্বায়িত্ব? ওই যে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন,কে করবে সেবা-যত্ন? এরপর আরো বয়স বাড়বে।ক্রমে শয্যাগত হবেন।সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে,যত শীঘ্র পারো এর একটা সুব্যবস্থা করো, না হলে ব্যাবসাপত্র ডগে তুলে দাদাকে নিয়ে ঘরে বসে থাকো। এই নামার শেষ কথা। আমি কিন্তু কিছুটি করবোনা।__একটু দমে গেলো প্রদীপ।
বললো- তাই বুঝি? তা তোমাকে কে বললো অরুণদা?
- গত কয়েকদিন আগে ফোন করেছিল অবনী?
পেয়ে বসলো প্রদীপ। আর বিয়ের কথা কিছু বলেনি?
-নাঃ! সেসব কথা কিছু বলেনি। বরং বলেছিল মেস-অথবা-পেয়িং গেষ্ট হয়ে চাকরি কটা বছর কাটিয়ে দিবে।পরে অবসরের পর পাকাপাকিভাবে কোনো ওল্ড হোম-এ ব্যবস্থা করে নেবে।
মাথা নেড়ে প্রদীপ বললো- তাহলে বোঝো।বিয়ের কথাটা তোমার মতো বন্ধুর কাছেও চেপে গেলো?
মাথাটা আরো গরম হয়ে গেলো,বারংবার ওর মুখ থেকে বিয়ের কথাটা শোনার জন্য।তবু বললাম- সেটাই আশ্চর্যের কথা। এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা রহস্য আছে। আসলে তোমাদেরই হয়তো দেখার ভুল হতে পারে।নাহলে যে অবনী আমার কাছে এতটুকু কিছু লুকোয় না, সে কিনা এতবড়ো একটা জবর খবর আড়াল করে রাখবে?
প্রদীপের উল্টো স্বর- আলবাত করবে।লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ওই বয়সে কেউ বিয়ের কথা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে প্রচার করে? তুমি খবর নিয়ে দেখো কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়।
- ঠিক আছে। খবর আমি নিশ্চয়ই নেবো।আর তোমার কথা যদি মিথ্যে হয় তাহলে -
মুখের কথা টেনে নিয়ে প্রদীপ বললো- তাহলে তোমাকেও আর কিছু বলতে হবে না অরুণদা।আমার ওই অখিল আর ওর বৌ-কে পাড়াছাড়া করবোই করবো।এ্যাঁ- এটাকি মগের মুল্লক নাকি? কোথায় থাকত এতো দাপট।বেকার হয়েইতো ঘুরছিলি।যদি অবনী মাস্টার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে বড়বাজারের ওই দোকানটা না কিনে দিতো? ব্যাবসার টাকা পেয়ে এখন খুব হিম্মৎ হয়েছে।যার বাড়ি তাকে কিনা বাড়ি ছাড়া করা! বেচারা তোদের জন্য জীবনটা মাটি করে দিলো অথচ তোরা কিনা তার দায়িত্ব নিতে পারবিনা? পাজি নচ্ছার কোথাকার। দেখাছি মজা।
প্রদীপের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছেই প্রথমেই গেলাম বাবার ঘরে। মা গত হয়েছেন দুবছর আগে। বাবা প্রায় শয্যাগত।বাথরুম আর বিছানার মধ্যেই তার গতিবিধি।ভালোমন্দ খবর নেবার পর বললেন- বৌমা আসেনি।
বললাম- না বাবা, ও চলে আসানসোল গেছে ওর ভাইয়ের কাছে।
বললেন- ঠিক আছে, এবার এস। চা-টা খেয়ে বিশ্রাম করো। কইরে লুসি, মাকে বল জেঠুর চা-টিফিন দিতে।
বাবারা এমনি হয়ে থাকেন।আর মায়েদের তো কোনো কোথায় নেই।সন্তানদের জন্য যেন বেঁচে থাকা।তাদের সুখ সুবিধা দেখাটা যেন জীবনের ব্রত।
খুব আস্তে করে বললাম- আঃ! বাবা এতো ব্যস্ত হবে না।দিচ্ছে তো।
কথা শেষ হতে না হতেই পৌঁছে গেলো ভাইঝি লুসি।হাতের ট্রেতে দাদুর কমপ্ল্যান ধরে দিয়ে বললো এস জেঠুমনি,মা তোমার জন্য টিফিন রেডি করছে।হাত পা ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়ে খাবার টেবিলে এসে বসলাম।লুসি সামনে এনে রাখলো এক প্লেট ম্যাগী।বললো দেখতো কেমন হয়েছে?
জানতে চাইলাম- কেনরে তুই বানিয়েছিস বুঝি?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো লুসি।
এক চামচ মুখে পুরে বললাম- তাহলে তো ভালো হতেই হবে।তারপর আর এক চামচ মুখে নিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টি মেলে বললাম- হ্যাঁরে সত্যি ভালো হয়েছে।বিশেষ করে ম্যাগী মশলার ওই গন্ধটায় জেনো খাই খাই ভাব থাকে।
চা নিয়ে এলো সঙ্গীতা।বললো-দিদি এক গেলো আসানসোলে।আপনিও যেতে পারতেন।
বললাম- না না এক নয়।ছেলেদেরকে সঙ্গে নিয়েই গেছে।আমিও যেতাম,এবং সেই মতো ছুটিও নিয়েছিলাম।কিন্তু অবনীর ফোন পেয়েই বাড়ি চলে এলাম।
আশ্চর্য্য হবার ভান করে সঙ্গীতা বললো- হ্যাঁ দাদা,সত্যিই বোরো তাজ্জব ব্যাপার।বুড়ো বয়সে কি কেলেঙ্কারি কান্ড।ওঁর মতো এমন একজন নামকরা লোক যে এরকম হাসাহাসির ঘটনা ঘটাতে পারেন-এযেন স্বপ্নের অতীত।
লুসিকে অনিমেষ নেত্রে তার মায়ের কথাগুলো শুনতে দেখে বললাম লুসি তোর খাওয়া হয়েছে তো? এবার পড়াশুনা করবি যা।
খাওয়া শেষ করে উঠে যেতে লুসির সময় লাগলো কিছুটা।প্রদীপের সঙ্গে বচসা হবার পর মানটা বিগড়ে ছিল.এবার সঙ্গীতার মুখে সেই প্রসঙ্গ শুনে বিষন্ন বেদনায় ছেয়ে গেলো অন্তর। না জেনে না বুঝে কত সহজে মানুষ অন্যকে দোষারোপ করতে পারে।কোন অসহায় ব্যাক্তির অবস্থান কিংবা পরিস্থিতি বিচার না করে তার মাথায় চাপিয়ে দেয় কলংকের ডালি।হাসে বিদ্রুপের হাসি,ছুঁড়ে দেয় অভিযোগের তীর।
বললাম- কেন? অবনী কি করছে এমন করেছে যে লোক হাসাহাসির কারণ হয়ে গেছে?
এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সঙ্গীতা বললো- কি করেছে সেটা ফোনে বলেন নি? অথচ আপনি ফোন পেয়ে চলে এলেন?
বললাম- নাঃ! কি করেছে সেটা বলেনি।বরং সে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তার থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে,সেই যুক্তিটাই সে চেয়েছে।
-তাই নাকি? পরিহাসের সুর ঢেলে সঙ্গীতা বললো,- তও বটে। কিন্তু দাদা পরিস্থিতি যে বড্ডো জটিল।কাকে যুক্তি দেবার জন্য ছুটে এসেছেন আপনি? বেচারা পরিস্থিতির শিকার হবার আগেই বৌ নিযে কোথায় যে উধাও হলেন যে কে জানে? একেবারে পাড়াছাড়া।
গলায় জোর দিয়ে বললাম- বৌ!
-হ্যাঁ!উনি বিয়ে করছেন।এটাই ঘটনা।অথচ আপনাকে জানায়নি?
পাল্টা প্রশ্ন করলাম ওকে- তুমি দেখেছো অবনীর বৌকে?
-না! সে সুযোগ আর হলো কোই।ঘটনার প্রচার হবার আগেই উনি প্রস্থান করেছেন মঞ্চ থেকে।
-ও! তাহলে শোনা কথা? সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়।
এবার সঙ্গিতা বসে পড়লো চেয়ারে।তারপর গলায় জোর দিয়ে বললো- অবনী বাবুর নামে মিথ্যে অপবাদ দেবার লোক এ পড়ায় বিরল।আর মিথ্যে বলে ওদেরই বা লাভ কি? যা দেখেছে তাই বলেছে।
রাগে রি রি করে উঠলো গা-টা।ধীর গলায় বললাম- মাথায় ঘোমটা দেওয়া বৌ সঙ্গে থাকলেই বৌ হয়ে যায়না? আর যদি সত্যিই হয় তাহলে হাসাহাসি করার কারণটাই বা কি?
- কি আবার করবে।বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে।
অধৈর্য্য হয়ে বললাম- আঃ প্রদীপ! খোলসা করে বোলো অবনী কি করেছে?
বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে নিয়ে প্রদীপ বললো- বিয়ে করেছে গো বিয়ে।
ধমকে উঠলাম আমি।ফচকামী করার জায়গা পাওনা? সরে দাঁড়াও আমাকে যেতে দাও।
মাথা চুলকে প্রদীপ বললো- ফচকামী করবো কেন অরুণদা? তুমি কি আমায় বখশিস দিবে? না আমি বিনে পয়সায় ভাত-কাপড় পাবো? এইতো গত পাঁচ দিন আগের কথা। এতবড়ো একটা ধিঙ্গি বউ নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলো অবানিদা। আগে থেকে জানতে পেরে চোখের সামনেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে অখিল। অনেক ডাকা-ডাকির পরও দরজা খুলেনি কেউ। বেচারা অবনীদা সদ্য বিয়ে করা বৌ নিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলো কে জানে।
প্রদীপ অখিলের বখাটে বন্ধু।বিশ্বাস করতে পারলাম না ওর কথা।তাছাড়া অবনীর নামে মিথ্যে অপবাদ সহ্য করতে পারলাম না আমি।রগে টগবগ করে উঠলো গায়ের রক্ত।
গলায় জোর দিয়ে বললাম-অখিলের কি হোক আছে দরজা বন্ধ করার? বাড়িটাতো অবনীই বানিয়েছে?
বুক ফুলিয়ে প্রদীপ বললো- অখিলের হক আছে ও তার ভাই বলে।দাদা অনাচার করবে আর ভাই সেটা মেনে নেবে? বানিয়েছে বলেই সেই বাড়িতে সে যা খুশি তাই করবে? দেখো অরুণদা- বন্ধু বলে তোমার দরদ উথলে উঠতে পারে,কিন্তু পাড়ার আমরা সবাই তাই সহ্য করবো কেন?
ধমকে উঠে বললাম- ঠিক করে কথা বল প্রদীপ। বিয়ে করাটা যদি অনাচার হয় তাহলে তুমি আমি এবং বিবাহিত সকলেই তো সেই দোষে দোষী।তবে আমাদেরই বা ঘরে থাকার হক থাকবে কেন?
চোখ কপালে তুলে প্রদীপ বললো- আমাদের বিয়ে আর অবনীদার বিয়ে এক হলো?
- এক নয় কেন? তফাতটা কোথায় সেটা বুঝিয়ে বোলো।
থ মেরে গেলো প্রদীপ।তোতলাতে তোতলাতে বললো- না, মানে আমরা যখন বিয়ে করেছিলাম তখন, তখন আমাদের বয়সটা ছিল একুশ থেকে পঁচিশের মধ্যে।আর অবানিদার বয়সটা-
ওর মুখ থেকে কথাটা টেনে নিয়ে বললাম- পঞ্চান্ন হয়েছে বলে তার বিয়ে করাটা অনাচার? তাই যদি হয় গত চারমাস আগে সোমা কাকিমা মারা যাবার পর সাতান্ন বছরে শশধর কাকা যখন বিয়ে করলো,কোই তখন তো তার ঘরের দরজা কেউ বন্ধ করে দেয়নি?
মুখে খই ফুটিয়ে প্রদীপ বললো- কেন দেবে শুনি? শশধর কাকা বিযে না করলে ওর বাচ্চা-কাচ্চা-সংসার কে দেখতো?অতলে ডুবে যেত ওর ভরা সংসার।
- ওঃ! তাই শশধর কাকার কোনো দোষ নেই।কিন্তু অবনীর ছেলেমেয়ে সংসার না থাকলেও অতো নিজেই একজন জলজ্যান্ত মানুষ।ওর রোগব্যাধি আছে।ত্খন ওকে কে দেখবে?
- তাহলে এতদিন ওকে কে দেখেছিলো শুনি?
- দেখেছিলো ভাইবোনেরা।তাই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাপ-মা মোর ভাইবোনেদের জন্য।
- এখনও ওরাই দেখবে।
- না, এখন ওরা দেখতে পারবেনা।বোনেরা শশুরবাড়ি চলে গেছে।ভাই এখন বৌয়ের বর।সুতরাং,ওরা নাকি আর অবনীর দেখাশোনা কিংবা রান্নাবান্না করে দিতে পারবেনা।
- তাই নাকি! অখিল বলেছে ওই কথা?
- না! বলেছে ওর বৌ।আর সর্বান্তকরণে সেটা সমর্থন করছে অখিল।
- কি বলেছে অখিলের বৌ?
- সাকিব কথা কি বলা যায়?তার মধ্যে একটি হলো 'বিয়ে না করে যদি মদন বিজয়ী হওয়ার ইচ্ছা তাহলে সন্ন্যাসী হলেন না কেন?' সংসারে থাকার দরকারটাই বা কি? কে নেবে উনার দ্বায়িত্ব? ওই যে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন,কে করবে সেবা-যত্ন? এরপর আরো বয়স বাড়বে।ক্রমে শয্যাগত হবেন।সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে,যত শীঘ্র পারো এর একটা সুব্যবস্থা করো, না হলে ব্যাবসাপত্র ডগে তুলে দাদাকে নিয়ে ঘরে বসে থাকো। এই নামার শেষ কথা। আমি কিন্তু কিছুটি করবোনা।__একটু দমে গেলো প্রদীপ।
বললো- তাই বুঝি? তা তোমাকে কে বললো অরুণদা?
- গত কয়েকদিন আগে ফোন করেছিল অবনী?
পেয়ে বসলো প্রদীপ। আর বিয়ের কথা কিছু বলেনি?
-নাঃ! সেসব কথা কিছু বলেনি। বরং বলেছিল মেস-অথবা-পেয়িং গেষ্ট হয়ে চাকরি কটা বছর কাটিয়ে দিবে।পরে অবসরের পর পাকাপাকিভাবে কোনো ওল্ড হোম-এ ব্যবস্থা করে নেবে।
মাথা নেড়ে প্রদীপ বললো- তাহলে বোঝো।বিয়ের কথাটা তোমার মতো বন্ধুর কাছেও চেপে গেলো?
মাথাটা আরো গরম হয়ে গেলো,বারংবার ওর মুখ থেকে বিয়ের কথাটা শোনার জন্য।তবু বললাম- সেটাই আশ্চর্যের কথা। এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা রহস্য আছে। আসলে তোমাদেরই হয়তো দেখার ভুল হতে পারে।নাহলে যে অবনী আমার কাছে এতটুকু কিছু লুকোয় না, সে কিনা এতবড়ো একটা জবর খবর আড়াল করে রাখবে?
প্রদীপের উল্টো স্বর- আলবাত করবে।লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ওই বয়সে কেউ বিয়ের কথা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে প্রচার করে? তুমি খবর নিয়ে দেখো কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়।
- ঠিক আছে। খবর আমি নিশ্চয়ই নেবো।আর তোমার কথা যদি মিথ্যে হয় তাহলে -
মুখের কথা টেনে নিয়ে প্রদীপ বললো- তাহলে তোমাকেও আর কিছু বলতে হবে না অরুণদা।আমার ওই অখিল আর ওর বৌ-কে পাড়াছাড়া করবোই করবো।এ্যাঁ- এটাকি মগের মুল্লক নাকি? কোথায় থাকত এতো দাপট।বেকার হয়েইতো ঘুরছিলি।যদি অবনী মাস্টার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে বড়বাজারের ওই দোকানটা না কিনে দিতো? ব্যাবসার টাকা পেয়ে এখন খুব হিম্মৎ হয়েছে।যার বাড়ি তাকে কিনা বাড়ি ছাড়া করা! বেচারা তোদের জন্য জীবনটা মাটি করে দিলো অথচ তোরা কিনা তার দায়িত্ব নিতে পারবিনা? পাজি নচ্ছার কোথাকার। দেখাছি মজা।
প্রদীপের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছেই প্রথমেই গেলাম বাবার ঘরে। মা গত হয়েছেন দুবছর আগে। বাবা প্রায় শয্যাগত।বাথরুম আর বিছানার মধ্যেই তার গতিবিধি।ভালোমন্দ খবর নেবার পর বললেন- বৌমা আসেনি।
বললাম- না বাবা, ও চলে আসানসোল গেছে ওর ভাইয়ের কাছে।
বললেন- ঠিক আছে, এবার এস। চা-টা খেয়ে বিশ্রাম করো। কইরে লুসি, মাকে বল জেঠুর চা-টিফিন দিতে।
বাবারা এমনি হয়ে থাকেন।আর মায়েদের তো কোনো কোথায় নেই।সন্তানদের জন্য যেন বেঁচে থাকা।তাদের সুখ সুবিধা দেখাটা যেন জীবনের ব্রত।
খুব আস্তে করে বললাম- আঃ! বাবা এতো ব্যস্ত হবে না।দিচ্ছে তো।
কথা শেষ হতে না হতেই পৌঁছে গেলো ভাইঝি লুসি।হাতের ট্রেতে দাদুর কমপ্ল্যান ধরে দিয়ে বললো এস জেঠুমনি,মা তোমার জন্য টিফিন রেডি করছে।হাত পা ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়ে খাবার টেবিলে এসে বসলাম।লুসি সামনে এনে রাখলো এক প্লেট ম্যাগী।বললো দেখতো কেমন হয়েছে?
জানতে চাইলাম- কেনরে তুই বানিয়েছিস বুঝি?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো লুসি।
এক চামচ মুখে পুরে বললাম- তাহলে তো ভালো হতেই হবে।তারপর আর এক চামচ মুখে নিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টি মেলে বললাম- হ্যাঁরে সত্যি ভালো হয়েছে।বিশেষ করে ম্যাগী মশলার ওই গন্ধটায় জেনো খাই খাই ভাব থাকে।
চা নিয়ে এলো সঙ্গীতা।বললো-দিদি এক গেলো আসানসোলে।আপনিও যেতে পারতেন।
বললাম- না না এক নয়।ছেলেদেরকে সঙ্গে নিয়েই গেছে।আমিও যেতাম,এবং সেই মতো ছুটিও নিয়েছিলাম।কিন্তু অবনীর ফোন পেয়েই বাড়ি চলে এলাম।
আশ্চর্য্য হবার ভান করে সঙ্গীতা বললো- হ্যাঁ দাদা,সত্যিই বোরো তাজ্জব ব্যাপার।বুড়ো বয়সে কি কেলেঙ্কারি কান্ড।ওঁর মতো এমন একজন নামকরা লোক যে এরকম হাসাহাসির ঘটনা ঘটাতে পারেন-এযেন স্বপ্নের অতীত।
লুসিকে অনিমেষ নেত্রে তার মায়ের কথাগুলো শুনতে দেখে বললাম লুসি তোর খাওয়া হয়েছে তো? এবার পড়াশুনা করবি যা।
খাওয়া শেষ করে উঠে যেতে লুসির সময় লাগলো কিছুটা।প্রদীপের সঙ্গে বচসা হবার পর মানটা বিগড়ে ছিল.এবার সঙ্গীতার মুখে সেই প্রসঙ্গ শুনে বিষন্ন বেদনায় ছেয়ে গেলো অন্তর। না জেনে না বুঝে কত সহজে মানুষ অন্যকে দোষারোপ করতে পারে।কোন অসহায় ব্যাক্তির অবস্থান কিংবা পরিস্থিতি বিচার না করে তার মাথায় চাপিয়ে দেয় কলংকের ডালি।হাসে বিদ্রুপের হাসি,ছুঁড়ে দেয় অভিযোগের তীর।
বললাম- কেন? অবনী কি করছে এমন করেছে যে লোক হাসাহাসির কারণ হয়ে গেছে?
এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সঙ্গীতা বললো- কি করেছে সেটা ফোনে বলেন নি? অথচ আপনি ফোন পেয়ে চলে এলেন?
বললাম- নাঃ! কি করেছে সেটা বলেনি।বরং সে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তার থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে,সেই যুক্তিটাই সে চেয়েছে।
-তাই নাকি? পরিহাসের সুর ঢেলে সঙ্গীতা বললো,- তও বটে। কিন্তু দাদা পরিস্থিতি যে বড্ডো জটিল।কাকে যুক্তি দেবার জন্য ছুটে এসেছেন আপনি? বেচারা পরিস্থিতির শিকার হবার আগেই বৌ নিযে কোথায় যে উধাও হলেন যে কে জানে? একেবারে পাড়াছাড়া।
গলায় জোর দিয়ে বললাম- বৌ!
-হ্যাঁ!উনি বিয়ে করছেন।এটাই ঘটনা।অথচ আপনাকে জানায়নি?
পাল্টা প্রশ্ন করলাম ওকে- তুমি দেখেছো অবনীর বৌকে?
-না! সে সুযোগ আর হলো কোই।ঘটনার প্রচার হবার আগেই উনি প্রস্থান করেছেন মঞ্চ থেকে।
-ও! তাহলে শোনা কথা? সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়।
এবার সঙ্গিতা বসে পড়লো চেয়ারে।তারপর গলায় জোর দিয়ে বললো- অবনী বাবুর নামে মিথ্যে অপবাদ দেবার লোক এ পড়ায় বিরল।আর মিথ্যে বলে ওদেরই বা লাভ কি? যা দেখেছে তাই বলেছে।
রাগে রি রি করে উঠলো গা-টা।ধীর গলায় বললাম- মাথায় ঘোমটা দেওয়া বৌ সঙ্গে থাকলেই বৌ হয়ে যায়না? আর যদি সত্যিই হয় তাহলে হাসাহাসি করার কারণটাই বা কি?
No comments